সানা উল্লাহ সানু

মহামান্য আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী ২৮ সেপ্টেম্বর থেকে অনিবন্ধিত নিউজ পোর্টালগুলো বন্ধের প্রক্রিয়া শুরু করে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন-বিটিআরসি। আদালতের নির্দেশে অনিবন্ধিত নিউজপোর্টাল বন্ধের প্রক্রিয়া শুরু করে একই দিন মঙ্গলবার সন্ধ্যায় প্রক্রিয়াটি স্থগিত করা হয়েছে। দেশের প্রচলিত সকল ধরনের গণমাধ্যমের খবরে তা জানা গেছে।

কারণ হিসেবে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার গণমাধ্যমকে জানান, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের দেয়া তালিকা অনুযায়ী অনিবন্ধিত নিউজ পোর্টালগুলো বন্ধ করা হবে। এ জন্য আদালতের কাছে নতুন করে সময়ও চাওয়া হয়েছে।

এর আগে ১৪ সেপ্টেম্বর দেশের সব অনিবন্ধিত অনলাইন নিউজ পোর্টাল বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে মহামান্য হাইকোর্ট। এ খবরগুলোই হচ্ছে বাংলাদেশে অনলাইন নিউজপোর্টাল নিয়ে আপাতত সর্বশেষ খবর।

আদালতের আদেশ পালন করতে গিয়ে অনিবন্ধিত কিন্ত নিবন্ধনের জন্য আবেদন করা নিউজপোর্টাল গুলোর বিষয়ে তথ্য মন্ত্রনালয় কি সিদ্ধান্ত নেয় সেটা জানার অপেক্ষা করছে এর সাথে সংশ্লিষ্টরা। অন্যদিকে যে সকল নিউজপোর্টাল নিবন্ধনের জন্য আবেদনই করেনি তাদের বিষয়ে কোন নির্দেশ ছাড়াই সরকার যখন তখন সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এতে কারো কোন আপত্তি নেই।

জানা যায়, ২০১৫ সালে অনলাইন নিউজপোর্টাল নিবন্ধনের জন্য তথ্য মন্ত্রনালয়ে আবেদন করেও আজ পর্যন্ত নিবন্ধন পায়নি আবেদন করা অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোর অনেকে। বিভিন্ন সংস্থার একাধিকবার তদন্ত করা সত্ত্বেও অনেকে জানে না তাদের আবেদনটি কোন অবস্থায় আছে? কথা উঠছে, বহু পরে আবেদন করেও কেউ কেউ নিবন্ধন পেয়েছেন। অনেকে চাচ্ছে নিবন্ধন দেয়ার প্রক্রিয়ায়টি প্রথম আবেদনটি
থেকেই যেন সিরিয়াল ভিত্তিক সম্পন্ন করা হয়। কিন্ত আপাতত মনে হচ্ছে আবেদন নিষ্পত্তিতে পুরাতন আবেদন থেকে সিরিয়াল অনুসরণ করা হচ্ছে না।

২০১৫ সালে প্রথম বিজ্ঞপ্তির পর নিবন্ধনের জন্য আবেদন করা নিউজপোর্টালগুলোর আবেদন নিষ্পত্তি না করেই পরবর্তীতে

আরো আবেদন গ্রহন চালু রাখে তথ্য মন্ত্রনালয়। যার কারণে নিবন্ধন নিয়ে তৈরি হয় নানা জটিলতা, এমন বক্তব্য অনলাইন নিউজপোর্টালের সাথে সংশ্লিষ্টদের।

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, পৃথিবীব্যাপি ও বাংলাদেশে চালু হওয়া নতুনধারার গণমাধ্যমই আজকের অনলাইন নিউজপোর্টাল। শুরুতে এর নাম ছিল ইন্টারনেট সংবাদপত্র। ২০০৬ সালের জুন মাসে বিডিনিউজটোয়েন্টিফোরের মাধ্যমেই বাংলাদেশে প্রথমবারের ন্যায় ইন্টারনেট ভিত্তিক সংবাদপত্র প্রকাশ শুরু হয়।

বর্তমানে অনলাইন ভিত্তিক প্রকাশিত গণমাধ্যম সমূহকে পৃথিবীর অন্যান্য দেশে ডিজিটাল নিউজ মিডিয়া নামে ডাকা শুরু হচ্ছে। সকল ধরনের মিডিয়াকে ডিঙ্গিয়ে এখন এককভাবে রাজত্ব শুরু করেছে এ ডিজিটাল নিউজ মিডিয়া বা অনলাইন মিডিয়া।

২০০৬ সাল থেকে বাংলাদেশে ইন্টারনেট ভিত্তিক সংবাদপত্র প্রকাশের প্রচলন শুরু হলেও এটা নিয়ে দেশে সুনিদির্ষ্ট কোন আইনকানুন ও নীতিমালা ছিল না। সেজন্য ২০১২ সালে অনলাইন গণমাধ্যম পরিচালনা নীতিমালা-২০১২ নামে একটি খসড়া আইন তৈরি করে তৎকালীন তথ্য মন্ত্রনালয়। কিন্ত সে নীতিমালায় জটিল কিছু বিষয় উল্লেখ থাকায় নাগরিক বির্তকের মুখে উক্ত নীতিমালা সংশোধনের আশ্বাস
দেয় সরকার। পরে ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে গণবান্ধব অনলাইন নীতিমালা প্রণয়নের জন্য তথ্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রধান তথ্য কর্মকর্তাকে আহবায়ক করে অনলাইন গণমাধ্যম সহায়ক খসড়া নীতিমালা প্রণয়ন কমিটি গঠন করা হয়।

মূল কমিটিকে সহায়তা করার জন্য বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির পরিচালক ও বর্তমান ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তফা জব্বারকে আহ্বায়ক করে আরো একটি উপ-কমিটি গঠন করা হয়। উপ-কমিটিতে তথ্য প্রযুক্তিবিদ, বাংলাদেশ অনলাইন নিউজ পোর্টাল এ্যাসোসিয়েশন(বনপা), বিটিআরসির প্রতিনিধি এবং বিভিন্ন মিডিয়ার সম্পাদক ও সাংবাদিকসহ সরকারি ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা যুক্ত ছিলেন।

উক্ত উপকমিটি এবং মূল কমিটি পূর্বের প্রণয়নকৃত নীতিমালা বাদ দিয়ে বিনামূল্যে রেজিষ্ট্রেশনের বিধান রেখে চুড়ান্ত অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালা প্রণয়ন করে মন্ত্রনালয়ে জমা দেয় । তবে বিনামূল্যে এবং গণবান্ধব অনলাইন নীতিমালা প্রণয়নে শুরু থেকেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে বাংলাদেশ অনলাইন নিউজ পোর্টাল এ্যাসোসিয়েশন (বনপা)। সংগঠনটির সভাপতি শামছুল আলম স্বপনের ডাকে এর সদস্যরা ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন স্থানে মানববন্ধনসহ আন্দোলন করে। একাধিকবার তথ্য মন্ত্রনালয়ে বৈঠক হয়। অবশেষে ২০১৫ সালের মার্চ মাসে উপ-কমিটি ও মূল কমিটি অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালা চুড়ান্ত করে মন্ত্রনালয়ে প্রেরণ করে।

এ নীতিমালার প্রেক্ষিতে ২০১৫ সালের ৯ নভেম্বর তারিখে তথ্য মন্ত্রনালয়ের তথ্য অধিদপ্তর এক তথ্যবিবরণীর মাধমে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে নিউজপোর্টাল নিবন্ধনের জন্য আবেদন আহবান করে। সে তথ্যবিবরণীর সূত্রে অনলাইন নিউজপোর্টাল গুলো নিবন্ধন চেয়ে তথ্য অধিদপ্তরে আবেদন করে। ১৫ ডিসেম্বরের পর আবেদন গ্রহন আরো ১ সপ্তাহ বৃদ্ধি করে তথ্য মন্ত্রনালয়।

আবেদন গ্রহনের ৬ মাস পর ২০১৬ সালের ২৬ জুন তারিখে তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু জাতীয় সংসদকে জানিয়েছিলেন, দেশে ১৭১৭টি অনলাইন নিউজমিডিয়া নিবন্ধনের জন্য তথ্য মন্ত্রনালয়ে আবেদন করেছিল।

সেসময়ে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করা অনলাইন গণমাধ্যমের কয়েকজন প্রকাশক জানান, আবেদনের পর তথ্য মন্ত্রনালয় তাদের একটি তালিকা প্রণয়ন করে। সে তালিকায় আবেদিত অনলাইন সমূহের নামের পাশে একটি কোড দেয়া হয়। পরে তথ্য মন্ত্রনালয়ের ওই তালিকা ধরে সরকারের গুরুক্বপূর্ণ তিনটি গোয়েন্দা সংস্থা আবেদিত অনলাইনসমূহ তদন্ত করে। চলমান সে তদন্তে ২০২১ সাল পর্যন্ত কিছু
সংস্থা কোন কোন নিউজপোর্টালের ২ থেকে ৩ বারও তদন্ত করে বলে জানান, অনলাইন নিউজপোর্টালের নিবন্ধন চাওয়া ব্যক্তিরা।

২০১৫ সালে প্রণয়নকৃত নীতিমালায় প্রচলিত পত্রিকা, রেডিও, টেলিভিশনের অনলাইন ভার্সনের নিবন্ধন নেয়ার কোন তথ্য ছিল না। অনলাইন ও প্রচলিত ভার্সন ভিন্ন হলে এসকল গণমাধ্যমের জন্যও অনলাইন নিবন্ধন নেয়া বাধ্যতামূল করে আগের নীতিমালা সংশোধন করা হয় ২০১৭ সালে। পরে ২০১৭ সালের ১৯ জুন ‘জাতীয় অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালা- ২০১৭’ এর খসড়া অনুমোদন দেয় মন্ত্রীসভা।

এরপরে আরো তিন বছর পর অনলাইন গণমাধ্যমের নিবন্ধন, মানোন্নয়নসহ ১৪টি ইস্যুতে সংশোধনী এনে ২০২০ সালের ৩১ আগষ্ট পত্রিকা, টেলিভিশন ও রেডিও চ্যানেলের অনলাইন সংস্করণের জন্য নিবন্ধন বাধ্যবাধকতা রেখে জাতীয় অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালা ২০২০ এর খসড়া ও চুড়ান্ত অনুমোদন করে মন্ত্রীসভা।

২০২০ সালের নীতিমালায় প্রথমবারের মতো আইপি টিভি ও ইন্টারনেট রেডিও সম্প্রচারে নিবন্ধনের বিষয়গুলো যুক্ত করা হয়। এটি মন্ত্রীসভা চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়। এরমাধ্যমে বাংলাদেশ সরকার অনলাইন সংবাদমাধ্যম পরিচলানার জন্য একটি আইন পায়।

২০২০ সালে পাশ হওয়া নীতিমালা অনুযায়ী, অনলাইন গণমাধ্যমকে প্রস্তাবিত সম্প্রচার কমিশনের কাছ থেকে নিবন্ধন নিতে হবে। তবে কমিশন হওয়ার আগ পর্যন্ত তথ্য মন্ত্রণালয় তা দেখাশোনা করবে। বর্তমানে তথ্য মন্ত্রণালয় বিষয়টি দেখছে।

উক্ত আইনের আওতায় ২০২০ সালের ৩০ জুলাই তারিখে সরকার প্রথম বারের মতো ৩৪টি অনলাইন নিউজ পোর্টালকে নিবন্ধনের অনুমতি দেয়। ২য় দফা ৩ সেপ্টেম্বর তারিখে ৯২টি পত্রিকার অনলাইন ভার্সন নিবন্ধনের অনুমতি পায়। সবশেষে ৩য় ধাপে ২৯ নভেম্বর তারিখে আরো ৫১টি অনলাইন পত্রিকা নিবন্ধনের অনুমতি পায়। কিন্ত এখনো কোন টেলিভিশন এবং বেতারের অনলাইন ভার্সনের কোন নিবন্ধন দেয়া হয়নি।

যদিও সকল ধরনের প্রচলিত মিডিয়া তাদের সংবাদ ও অনুষ্ঠানের প্রায় ৯৫ ভাগই প্রচলিত ধারার পাশাপাশি অনলাইনেও প্রচার করছে। ক্ষেত্র বিশেষ সে সকল মিডিয়ার ওয়েবসাইটগুলো প্রচলিত ধারার বাহিরে ব্যতিক্রম প্রচার করলে সেগুলো অনিবন্ধিত হওয়ার কথা।

এরমধ্যেই অনিবন্ধনকৃত নিউজপোর্টাল বন্ধের আদেশ দিয়েছে উচ্চ আদালত। নিউজপোর্টাল মালিক ও সম্পাদকদের দাবি দ্রুত নিবন্ধন প্রক্রিয়া যেন শেষ করা হয়। একই সময়ে আবেদিত কিন্ত অনিবন্ধনকৃত নিউজপোর্টাল এরকম শব্দ থেকে মুক্তি পেতে চায় তারা। নিবন্ধন প্রক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত আবেদিত নিউজপোর্টালগুলো পরিচিত হতে চায় নিবন্ধনের জন্য প্রক্রিয়াধীন নিউজপোর্টাল নামে।

অন্যদিকে আবেদিতগুলোর মধ্যে প্রথম দিকে আবেদনকৃতদের আবেদন থেকেই যেন নিবন্ধন প্রক্রিয়া শেষ করা হয়, সে দাবিও তাদের। তাছাড়া পূর্বের আবেদনগুলো চুড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত নতুন কোন আবেদন যেন জমা না নেয়া হয়। তাদের বক্তব্য হচ্ছে বিষয়টি যতই চলমান প্রক্রিয়া হোক পূর্বের আবেদন যেন শেষ করা হয়।

অনলাইন নিউজপোর্টাল মালিক ও সম্পাদকদের শেষ অভিযোগ ও দাবী হচ্ছে, ২০১৫ সালে প্রথম ধাপে আবেদন জমা দিয়ে এবং বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে একাধিকবার তদন্ত করেও তাদের প্রতিষ্ঠান নিবন্ধনের জন্য কোন অবস্থায় আছে তা জানেনা তারা। নিউজপোর্টালের সাথে সংশ্লিষ্টদের প্রশ্ন একটি অনলাইন নিউজপোর্টালের নিবন্ধন প্রক্রিয়া শেষ হতে কত বছরে লাগবে ?

 

লেখক: লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি, দ্য বিজনেস স্ট্যার্ন্ডাড এবং সম্পাদক, লক্ষ্মীপুরটোয়েন্টিফোর